মধ্যপ্রাচ্যের আকাশে খাইবারের গর্জন যেন এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। এর আগে হয়তো অনেকে ভেবেছিল, ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র শক্তি পুরনো প্রযুক্তি আর রাশিয়ার কাছ থেকে নেয়া পুরনো ডিজাইনের ওপরই দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু ২০২৫ সালের জুনের সেই রাতে, যখন একের পর এক খাইবার ছুটে গেল ইসরাইলি ভূখণ্ডের দিকে, তখন অনেকেই বুঝতে পেরেছে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র শুধু হুমকি নয়, বাস্তবিক অর্থেই একেকটা চূড়ান্ত দুঃস্বপ্ন।
মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধক্ষেত্রের মানচিত্রে খাইবার এখন এক অশনি সংকেতের নাম। ইরানের তৈরি এই মধ্য-পাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র শুধু দূর পাল্লার আঘাত নয়, শত্রুর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে মানসিক চাপে ফেলতে এবং দ্রুত প্রতিক্রিয়া জানানোর উপযোগী করে নকশা তৈরি করা হয়েছে। যুদ্ধক্ষেত্রে এর সম্ভাব্য ব্যবহারের বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, খাইবার শত্রুর সুরক্ষা বলয়কে ভেদ করে আঘাত হানার কৌশলগত হাতিয়ার। তার আয়রন ডোমও যেন বেহুলার বাসর ঘর হয়ে ওঠে! বেহুলার লোহার বাসর ঘরে ঢুকেছিল একমাত্র কালসাপ। কিন্তু সুরক্ষা বলয়কে ভেদ করে ছুটে আসতে পারে একাধিক খাইবার। একযোগে আঘাত করবে বহু লক্ষ্যবস্তুতে।
খাইবার নিয়ে বিশ্লেষকরা বলছেন, এটি কেবল আঘাত হানার অস্ত্র নয়, বরং একটি কৌশলগত সিস্টেম, যা ইরানকে আঞ্চলিক যুদ্ধের সময় সাইকোলজিক্যাল অ্যাডভান্টেজ এনে দেয়। কারণ একবার যদি শত্রু বুঝতে পারে, যে কোনো মুহূর্তে একসাথে পাঁচ-ছয়টি ছোট ওয়ারহেড বা উড়ন্ত বোমা তার সামরিক ঘাঁটি, বিদ্যুৎকেন্দ্র, শিল্প এলাকা বা বিমানবন্দরে ধেয়ে আসতে পারে, তাহলে তার প্রতিরক্ষা পরিকল্পনা ভেঙে পড়তে বাধ্য।
ইরান এই ক্ষেপণাস্ত্রকে ডিটারেন্স ডকট্রিনের অংশ হিসেবে ব্যবহার করছে। অর্থাৎ ‘আপনি যদি আক্রমণ করেন, আমি এমন জবাব দেব যা আপনি ঠেকাতে পারবেন না।’ বিশ্লেষক রেজা ফারহাদি বলছেন, ‘খাইবার কেবল একটি ক্ষেপণাস্ত্রের নাম নয়, এ হলো ইরানের হুঁশিয়ারির ভাষা।’
প্রযুক্তিগত দিক থেকে, খাইবারের সবচেয়ে বিপজ্জনক বৈশিষ্ট্য ওয়ারহেডের ম্যানুভার বা লক্ষ্যবস্তুর দিকে বোমা ছুটে যাওয়ার সময় প্রয়োজনে পথ পরিবর্তনের ক্ষমতা। প্রতিটি ছোট ওয়ারহেড বা বোমা যখন আবহমণ্ডলে পুনরায় ঢুকতে থাকে, তখন এগুলোর ডানা সামান্য নাড়াচাড়া করতে পারে। ফলে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার রাডার আর কম্পিউটার প্রেডিকশন বা আক্রমণের পূর্বাভাস বিভ্রান্ত হয়ে যায়। এভাবে শত্রুর অ্যারো বা ডেভিডস স্লিংয়ের মতো মাল্টি-লেয়ার বা বহু স্তরের প্রতিরক্ষা সিস্টেম হঠাৎ একসাথে ধেয়ে আসা তিন থেকে পাঁচটি ওয়ারহেড বা বোমার প্রতি ঠিকমতো সাড়া দিতে পারে না। ইরান একে বলে ‘স্যাচুরেশন ট্যাকটিক্স’, অর্থাৎ একসাথে এতগুলো লক্ষ্যবস্তু নেয়া হয় যেন শত্রুর প্রতিরক্ষার হিসাব-নিকাশ জট পাকিয়ে যায়।
খাইবারকে দ্রুত পাল্টা জবাবি অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা সম্ভব। কারণ মোবাইল লঞ্চারকে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকতে হয় না। চালক চাইলে কয়েক কিলোমিটার দূরে গিয়ে আবার ক্ষেপণাস্ত্র ছুঁড়তে পারে। এর ফলে শত্রুপক্ষ, যেমন- ইসরাইল বা যুক্তরাষ্ট্রের ঘাঁটি থেকে বোঝা মুশকিল হয়ে যায়, কোথা থেকে আঘাত আসছে।
খাইবারের এই ক্ষমতা দেখা গিয়েছিল অপারেশন ওদে সাদেক ৩-এ। ইরানের দিক থেকে ২১তম ঢেউয়ে ছোড়া খাইবার একসাথে অধিকৃত ফিলিস্তিন বা ইসরাইলের আশদোদ শিল্প এলাকা, উত্তর অঞ্চলের একটি সামরিক ঘাঁটি এবং মধ্য অঞ্চলের একটি গোয়েন্দা কেন্দ্রে আঘাত করে। তিনটি লক্ষ্য একসাথে আঘাত পাওয়ায় ইসরাইলের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা প্রায় অকেজো হয়ে যায়। সামরিক সূত্র বলছে, এই কৌশলের ফলে প্রথম আঘাতেই শত্রুপক্ষের প্রতিরক্ষা-সংক্রান্ত কমান্ড সিস্টেম অচল হয়ে যায়, যার ফলে ইরান বারবার নতুন ক্ষেপণাস্ত্র মারতে পেরেছে।
খাইবারের সবচেয়ে বড় সীমাবদ্ধতা হলো, যাত্রা শুরুর প্রথম ধাপে এর তরল জ্বালানির প্রয়োজন হয়। তরল জ্বালানি ভর্তি করতে সময় লাগে। যুদ্ধের সময় এটি বড় রকমের সমস্যা তৈরি করতে পারে। তবে ইরান এ সমস্যার জন্য একধরনের হাফ-প্রি-ফিল্ড সিস্টেম বা আধা-পূর্ণ ব্যবস্থা তৈরি করেছে, যাতে অল্প সময়ে ক্ষেপণাস্ত্র প্রস্তুত করা যায়। সাধারণত তরল জ্বালানি চালিত ক্ষেপণাস্ত্রের সবচেয়ে বড় সমস্যা উৎক্ষেপণের ঠিক আগে জ্বালানি ভরতে হয়। এটি সময়সাপেক্ষ, কখনো এক থেকে তিন ঘণ্টা পর্যন্ত সময় লাগে। কিন্তু আধা-পূর্ণ পদ্ধতিতে বেশিভাগ জ্বালানি ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ার অনেক আগেই ভরা থাকে বা আলাদা ট্যাঙ্কে সংরক্ষিত থাকে। যুদ্ধকালীন জরুরি মুহূর্তে শুধু শেষ ধাপের জ্বালানি বা অক্সিডাইজার ভরলেই ক্ষেপণাস্ত্রটি ছোড়ার জন্য তৈরি হয়ে যায়। এতে অনেক সময় বাঁচে।
বৃহত্তর ভূ-রাজনীতির প্রেক্ষাপটে খাইবারের গুরুত্ব তখনই বোঝা যায়, যখন দেখা যায় এর পাল্লা কাকে টার্গেট করছে। এর এক হাজার ৯৫০ কিমি পাল্লা পুরো ইসরাইল, সৌদি আরব, পারস্য উপসাগরের মার্কিন ঘাঁটি, তুরস্কের দক্ষিণাংশ- সবই এর আওতায় পড়ে। আর এজন্যই খাইবারের প্রতিটি উৎক্ষেপণই একধরনের রাজনৈতিক বার্তা। এই বার্তা মধ্যপ্রাচ্যের শক্তির ভারসাম্যে প্রভাব ফেলে। যুক্তরাষ্ট্র বা ইসরাইলের শীর্ষ পর্যায়ের নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা প্রায়ই বলছেন, খাইবারের মতো ক্ষেপণাস্ত্র ইরানের হ্যান্ডশেক বা হাত মিলানো নয়, মুষ্টিবদ্ধ হাত। দরকারের সময় এ হাত কষিয়ে আঘাত হানতে প্রস্তুত।
খাইবারের বিকাশকে ইরানি প্রতিরোধের প্রতীক হিসেবেও ধরা হচ্ছে। কারণ ইরান আর বিদেশী প্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীল নয়। তেহরান নিজেরাই কম্পোজিট বডি, মাল্টিপল ওয়ারহেড, স্টিয়ারেবল ফিন, স্যাটেলাইট-নির্ভর গাইডেন্সসহ পুরো সিস্টেম বানাতে পারছে। এমনকি, সামরিক বিশ্লেষক আমির গাফুরি বলেন, ‘খাইবার ইরানকে কৌশলগতভাবে আত্মনির্ভরশীল করে তুলেছে। এটি মিসাইল টেকনোলজিতে এক বৈপ্লবিক অগ্রগতি।’
খাইবারের সবচেয়ে শক্তিশালী বার্তা, এটি একসাথে একাধিক ছোট ওয়ারহেডের মাধ্যমে শত্রুর বহু অবস্থান ধ্বংস করতে পারে। এটি শত্রুর জন্য শুধু সামরিক নয়, মানসিক চাপও তৈরি করে। কবে, কখন, কোথা থেকে আঘাত আসবে, তা নিয়ে দিন-রাত দুশ্চিন্তা বাড়ায় শত্রুর। খাইবার তাই আরেকটি ক্ষেপণাস্ত্রের নাম নয়, এটি এক গভীর বার্তা, এক গল্প- যে গল্পে ইরান তার শত্রুদের বলে দিচ্ছে, ‘আপনারা আঘাত করলে আমরা কেবল জবাব দেব না, সেই জবাব হবে এমন, যা একসাথে অনেক জায়গায় আপনাদের শিরদাঁড়া ভেঙে দেবে।’
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো যুদ্ধক্ষেত্রে খাইবারের ‘ডিটারেন্স’ কৌশলের অংশ। অর্থাৎ শত্রু হামলার আগে যেন দশবার ভাবে। খাইবার একবার ছুটলে শত্রুর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা পুরোপুরি ভেঙে পড়তে পারে। প্রতিটি খাইবার ইরানের ‘ক্যাপাবিলিটি-ডেমোনস্ট্রেশন’ বা সক্ষমতার নিদর্শন। শত্রুকে বোঝানোর কৌশল, আঘাত করলে পাল্টা আঘাত হবে আরো বিধ্বংসী। যুদ্ধের সময় এমন মনস্তাত্ত্বিক চাপই অনেক সময় আক্রমণ প্রতিরোধে সবচেয়ে বড় হাতিয়ার হয়ে ওঠে।
সবশেষে বলা যায়, খাইবার ইরানের জন্য শুধু অস্ত্র নয়, শত্রুর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার বিপরীতে এক ধরনের কৌশলগত মোহর, যা আকাশ থেকে শত্রুর ঘুম কেড়ে নিয়ে বলে দেয়, ‘ইরান আঘাতের জন্য প্রস্তুত, আর আপনাদের প্রতিরক্ষা অচল করে দেয়ার জন্যও।’
সূত্অ্যাডভান্টেজ এনে দেয়।
সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ